Constantinople

Constantinople

ঐতিহাসিক পথে:

নেপোলিয়ন বলেছিলো, যদি কখনো সমগ্র পৃথিবী একটা দেশে পরিণত হয় তাহলে তার রাজধানী হবার যোগ্যতা রাখে একটি মাত্র শহর, কনস্টান্টিনোপল
কনস্টান্টিনোপল ছিল দিগ বিজয়ী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। দুই মহাদেশে বিস্তৃত এই শহরে গড়ে উঠে প্রায় ২৫০০ বছর আগে। দুই দিকে সমুদ্র একদিকে পাহাড়, প্রাকৃতিক ভাবেই এই শহরটি সুরক্ষিত। সমুদ্রের ভেতরে রোমানেরা এক জাদুকরি উপায়ে বড় বড় কাঁটাযুক্ত চেইন স্থাপন করেছিলো, শত্রুপক্ষের কোন জাহাজ আসতে গেলে তারা চেইন টেনে দিতো, ফলে মাঝ সমুদ্রে জাহাজের তলা ছিদ্র হয়ে জাহাজ ডুবে যেত। পাহাড়ের উপর দিয়ে কোন সেনাবাহিনী মুভ করা সম্ভব না।
এছাড়া যে দিকে স্থলভাল সেদিকেও বহুস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এই প্রাচীর কোন কোন জায়গা ৫০ ফিট পর্যন্ত পুরু। প্রাচীরের একটু পর গোলন্দাজ বাহিনীর সুরক্ষিত নিরাপত্তা চৌকি, সব মিলিয়ে অভেদ্য শহর কনটান্সিটনোপল।

এক অদ্ভুত প্রবাদঃ

আমাদের গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, গল্পের গোরু গাছে উঠে। কনস্টান্টিনোপলের অভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ঠিক তেমনি একটা প্রবাদ ছিল, যদি কখনো সমুদ্রের জাহাজ কোনদিন পাহাড়ে উঠে তাহলেই কেবল কনস্টান্টিনোপল জয় করা সম্ভব।

ইসলামের আগমনঃ

শত শত বছর ধরে বিভিন্ন পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য চেস্টা করেছে কনস্টান্টিনোপল দখলের। কিন্তু কেউ একটা দেওয়ালও ভাঙতে পারেনি। সেখানে নতুন ধর্ম ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) কয়েকজন অনুসারীকে নিয়ে হেজাজের একটা অখ্যাত ছোট শহরে বসে উনার কয়েকজন গরিব অনুসারীকে বলেছিলেন,

❝ লাতাফতাহুন্নাল কুসতুনতিনিয়াতা, ফালা নে’মাল আমীরূ আমীরূহা ওয়ালানে’মা জাকাল জাইশু।❞ অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে তোমরা কুসতুনতিনিয়া জয় করবে। সুতরাং তার শাসক কতই না উত্তম হবে এবং তার জয় লাভকারী সৈন্যরাও কতই না উত্তম হবে! (মুসনাদে আহমদ)।

 

ইতিহাসে প্রথমঃ

কুসতুনতিনিয়া বিজয়ের সৌভাগ্য অর্জনের লক্ষ্যে খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকে অভিযান পরিচালনার স্বপ্ন দেখা হলেও হিজরী ৪৯/৬৬৯ সালে সর্বপ্রথম হযরত আমীর মোয়াবিয়া রা: কুসতুনতিনিয়ায় অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানে অন্যান্য প্রসিদ্ধ সেনাপতি ছাড়াও বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা: অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানেই তিনি অসুস্থ হয়ে ইন্তেকাল করেন। হযরত মোয়াবিয়া-তনয় ইয়াজিদও এই অভিযানে একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

শহর অবরোধকালে হযরত আনসারী রা: অসুস্থ হয়ে পড়লে ইয়াজিদ তার খেদমতে উপস্থিত হয়ে কোনো উপদেশ আছে কি না জিজ্ঞেস করেন। আনসারী রা: বলেন : ‘আমাকে দুশমনের ভূখন্ডের যতটুকু সম্ভব অগ্রভাগে নিয়ে যাবে এবং মৃত্যু হলে সেখানেই দাফন করবে।’ এই অছিয়ত (উপদেশ) বাস্তবায়ন করা হয়েছিল এবং ইন্তেকালের পর হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা:-কে কুসতুনতিনিয়ার প্রাচীরের নিকট দাফন করা হয়। অতঃপর রোমানদেরকে সাবধান করে দেয়া হয়, যদি তাঁর কবরের কোনো ক্ষতি সাধন করা হয়, তাহলে আরবের কোনো গির্জায় কখনও ঘণ্টা ধ্বনিত হবে না।

১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ কুসতুনতিনিয়া অভিযান চালান। তিনি রুপকথাকেই সিরয়াসলি গ্রহন করেন। এই রুপকথাই বাস্তব হয়ে যায়। সত্যি সত্যিই সমুদ্রের জাহাজ পাহাড়ে উঠে। তিনি পাহাড়ের উপর দিয়ে জাহাজ নিয়ে কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করেন। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ও সম্ভবত শেষ ঘটনা যখন জাহাজ পাহাড়ে উঠেছিলো। [ঘটনাটা কতটা অসম্ভব ছিল— পাহাড়ের উপর দিয়ে জাহাজ নিয়ে কসতুনতুনিয়া আক্রমণ করেন। whaaat!? It doesn’t even sound right]

বিজয়ের দিন

১৪৫৩ সালের ২৯ মে কনস্টান্টিনোপলের পতন হয়। বিজয় উপলক্ষে সুলতান মুহাম্মাদের উপাধি হয় আল ফাতিহ— বিজেতা।
মুহাম্মদ আল ফাতির উস্তাদ শায়খ আকশামসউদ্দিন এই সময়ে হযরত আবু আইয়ুব আনসারির কবর খুঁজে পান। আবু আইয়ুব আল আনসারি র. অছিয়তও পূর্ণ হয়। উনার উপর দিয়ে মুসলমান বাহিনী কনটান্সিটনোপলে প্রবেশ করে।

জয়ের দিন, এই ২১ বছর বয়েসি সেনাপতি বলেছিলেন,

আজ শহর নয়; আমার হৃদয় জয় করতে যাচ্ছি। তাই বিজয়ের পরে হয়নি কোন লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞ বা নারীদের অপমানের মচ্ছব। সুলতান মুহাম্মদের আগমনে শহরটিও যেন প্রাণ ফিরে পায়।৷

উপসংহার:

কনস্টান্টিনোপল বিজয় ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক অমর কীর্তি। এটি ছিল মুসলিম জাতির জন্য এক গৌরবময় অধ্যায়। এই বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এটি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

এই বিজয়ের পেছনে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহের অসামান্য নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা ছিল। তিনি ছিলেন একজন প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত ও দক্ষ সেনাপতি। তিনি কনস্টান্টিনোপল জয়ের জন্য কৌশলগতভাবে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। তিনি তাঁর সেনাদের মধ্যে এক অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করেন।

কনস্টান্টিনোপল বিজয়ে হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর অবদানও অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন একজন ত্যাগী ও বীর সাহাবী। তিনি কনস্টান্টিনোপল জয়ের জন্য অবিরাম সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি শহর অবরোধকালে ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী তাঁর কবরের উপর দিয়ে মুসলিম বাহিনী কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করে।

কনস্টান্টিনোপল বিজয় ছিল মুসলিম জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি মুসলিম জাতির সক্ষমতা ও ঐক্যের প্রতীক। এটি মুসলিম জাতির জন্য এক অনুপ্রেরণা।

Leave a Comment